লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি – নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ

Arif Hossain Arif Hossain 6 Min Read
লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি – নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ। দীর্ঘদিন যাবত আমি ভ্রমণ নিয়ে কিছু লিখি না। এমনটা নয় যে লিখতে ইচ্ছে করে না। তবে সময়ের সাথে লেখার হাত আর শৈল্পিক দৃষ্টি দুটোই কেমন যেন ব্যস্ততার ভারে চাপা পরে গিয়েছে। বাইরের হাস্যোজ্জ্বল খোলসের অন্তরালে ম্রিয়মান ক্লান্ত মনটা সেই রস আর দেয় নাহ আগের মতো। তবে এবারের ভ্রমণ নিয়ে কিছু না লিখে পারলাম নাহ। জানি কেওই মন দিয়ে এতদূর কষ্ট করে এই লিখা পড়বেন নাহ। পড়ার কথাও না। এত সময় কার আছে! তাই লিখছি নিজের জন্যেই।

সময়টা ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ। নিউ ইয়ারের ঠিক দুদিন আগে। আমার থার্টি ফার্স্ট নিয়ে কখনো কোনো প্ল্যান ছিলো না যথারীতি এবারও নেই। তাই বন্ধু সাব্বিরের হঠাত ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানটা কোনোভাবেই ফেলতে পারলাম নাহ। ময়মনসিংহ শহরে শীত তুলনামূলক বেশি। ভোরে উঠলে সকাল দেখা দায়৷ তবুও সকালে উঠে শীতে জড়সড় হয়ে বন্ধুবর সাব্বিরের সাথে চললাম সীমান্ত শহর দূর্গাপূরের উদ্দেশ্যে।

যাত্রাপথে মনোমুগ্ধকর গ্রামীণ দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য আমাকে বাস্তবতার একেবারে বাইরে নিয়ে গিয়েছিলো। কোথায় ঢাকার ব্যস্ত সড়ক, ধুলোবালি, আলোর দূষণ আর কোথায় সুন্দর সজীব নির্মল পরিবেশ! নাগরিক সুবিধা যে নেই সে কথা বলাই বাহুল্য। তবুও এখানকার মানুষের কাছে আর আমাদের কাছে নাগরিকের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা।

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

লেঙ্গুরা

দূর্গাপুর উপজেলার নাজিরপুর বাজারে নেমে খেয়াল করলাম সে জায়গায় রিকশার চেয়ে বাইকের আধিক্য বেশি। বুঝতে অসুবিধে হলো না কেনো। কারণ সেখানকার উপশহরের রাস্তা অনেকটা গলে যাওয়া গুড়ের দইয়ের মতো। কেও সেখানকার রাস্তার নাম চকলেট রোড বললেও অবাক হবো না। সেখানকার প্রায় সবাই কমরেড মনি সিংহের অনুরাগী। তবুও ক্যাপিটালিস্টদের নোংরা ছোবল পৌছে গিয়েছে সেখানেও।

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel
লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি

সোমেশ্বরী নদীর বুক চিড়ে অট্টালিকা গড়ার উপকরণ চালান দেয়া হচ্ছে শহরমুখী নাগরিকদের জন্য। যার ফলাফল এখানকার সড়কপথ। তবুও গ্রামের মানুষের এসবে সমস্যা নেই। প্রকৃতির ধ্বংসের বিনিময়ে দুটো টাকা পেটে জুটলে আপত্তি কোথায়! দোষ তো আর তাদের নাহ…!

আরও: পীর ও পার্বতীর পাহাড়ে

যাইহোক নাজিরপুর থেকে আমাদের রিসিভ করলো ওখানকার দুই বন্ধু Farhan Sadik এবং Safayet Sakib। সত্যি বলতে প্রকৃতির মোহনীয়তায় যতটা না মুগ্ধ হয়েছি তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছি তাদের আতিথিয়েতায়। যতটা সময় সেখানে ছিলাম একদমই মনে হয়নি অপরিচিত কোথাও এসেছি।

তাদের সাথেই বাইক পথে চলে আসলাম সোমেশ্বরী নদীর তীরে যেখানে এখনো কিছুটা জল অবশিষ্ট রয়েছে। এই এলাকাটা একদম ভারতের সীমান্তের সাথে লাগোয়া। বিজিবির ক্যাম্পের পাশ দিয়ে চলে গেলাম সোমেশ্বরীর ঘাটে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে। “আ ট্রিট টু দি আইস”। সোমেশ্বরী নদীও ঠিক তেমনই।

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

মেঘালয়ের ডাউকি নদীর আদলে সৃষ্ট স্বচ্ছ পানির জলধি যার পাড় ঘেষে রয়েছে পাহাড়ের আলোড়ন।স্থল এবং জলের এত সুন্দর মেলবন্ধন সচরাচর চোখে পরে না! তাই দেরি না করে নৌপথে বেরুলাম সোমেশ্বরী ভ্রমণে। সে ভ্রমণের কিছু অংশ ক্যামেরাবন্দী করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি বটে তবে সত্যিকারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে চলে আসতে হবে সোমেশ্বরী নদীর তীর ঘেষে গড়ে ওঠা এই ছোট্টো শহর দূর্গাপুরে।

ব্রাউন বাঙালির এক চিরায়ত অভ্যেস সূনীল,সমরেশের বই পড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি এক অলীক ফ্যান্টাসি গড়ে তোলার৷ আমিও সেই কাতারের বাইরে পরি না। তাই নৌভ্রমণ শেষে যখন সীমান্তের একদম কাছে চলে আসলাম তখন ভারতের একাংশ দেখে সেই অনুভূতির তীব্র অনুরণন উপেক্ষা করতে পারলাম নাহ। দক্ষিণ ভারত থেকে আগত এক বিশাল গোফওয়ালা বিএসএফ আর মেঘালয়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে।

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

সেদিনকার মতো ভ্রমণ শেষে চলে আসলাম মুগ্ধর বাসায়। রাতে আলাপ করলেম শুরু, চললো দীর্ঘক্ষণ। দুই ব্যবসায়ী সাফায়েত আর মুগ্ধ তাদের ব্যবসার সময়েও আমাদের সময় দিয়েছে অনেকক্ষণ। ক্ষণিকের মাঝেই খুব সুন্দর একটা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হয়ে গেছে আমাদের মাঝে। রাত যত বাড়লো অনুভব করতে শুরু করলাম পাহাড়ের তীব্র শীত, ভর করলো ক্লান্তি..গেলাম ঘুমিয়ে।

আরও: একদিনে সুনামগঞ্জ ভ্রমণ

সাত শহিদের মাজার

পরদিন সকালে উঠেই তড়িঘড়ি করে রওনা দিলাম লেংগুরার উদ্দেশ্যে। এতক্ষণ অবধি তাও ভারতের সীমান্তের কাছে নিজেদের সীমান্তে ছিলাম। কিন্তু পরদিন লেংগুরার যে জায়গায় গেলাম তা কেবল সীমান্তের সাথেই নয় বরং ভারতের সীমান্তের মধ্যেই। জায়গার নাম “সাত শহিদের মাজার”। সেখানে যুদ্ধের সময় আমাদের সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশকে কবর দেয়া হয়েছিলো বিধায় সেখানে এদেশীয় লোকের যতসামান্য আনাগোনা রয়ে গেছে। সে এলাকায় মূলত গারো এবং হাজং নৃগোষ্ঠির বাস। তারা অবলীলায় এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তে যাতায়াত করতে পারে।

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

বিএসএফদের ওদিকে খাদ্য উৎপাদনের সুব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশী গারো হাজংরা তাদের কাছে দেশীয় সবজী, খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে থাকে। রীতিমতো আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে তাদের মাঝে। ওখানে ঘোরা শেষে চলে গেলাম কালা পাথর নামের এক পাহাড়ে। খুবই সুন্দর পাহাড়। ওপর থেকে মেঘালয় স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু ওপারের সৌন্দর্য পুরোটাই আমাদের সীমান্তের বাইরে। ব্যাপারটা যখনই ভাবছিলাম সাফায়েত আমাকে একটা সুন্দর প্রশ্ন করলো,

বলো তো ওপাড়ের ওরা ভাগ্যবান নাকি আমরা?
আমি বললাম, ওরা। কারণ সীমান্তের সব সৌন্দর্য তো ওদের ভাগে।
সাফায়েত বললো, “উহু। সৌন্দর্যের মাঝে থাকার চেয়ে সৌন্দর্য দর্শন অনেক বেশি উপভোগ্য।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। কথা সত্য। আসলেই তো ওপার থেকে এপারে থাকলে তো আর বলতে পারতাম নাহ “এ ট্রিট টু আইস! “

এমন খুব কম ভ্রমণ আছে আমার জীবনে যেখান থেকে ফেরার পথে ভেতরে শূণ্যতা অনুভব করেছি। এই স্বল্প সময়ে সেখানকার প্রকৃতি, মানুষ তাদের প্রতি এত একটা মায়া জন্মেছে যে ফিরতি পথটা হয়ে গিয়েছিলো একদম বিষাদময়। তবুও স্মৃতিগুলো অসম্ভব সুন্দর। এবার তো সবে ট্রেইলার দেখে এসেছি। পুরো মুভি তো এখনো বাকি। আবার আসবো ফিরে এই সোমেশ্বরীর তীরে, ভরা বর্ষায়। প্রাণ ভরে দেখবো তার উন্মাদনা, হাটবো অদেখা ফান্দা ভ্যালিতে , অনুভব করবো পাহাড়ের চিৎকার, ভিজবো ঝর্ণায়..! সে অবধি বিদায়…

লেঙ্গুরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি - নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ - Fooxz Travel

যারা এতক্ষণ পর্যন্ত পড়েছেন আপনাদের ধৈর্য আছে বলতে হবে। না আমার ক্যামেরা ভালো আর না ক্যামেরার হাত। তবুও এই অসম্ভব সুন্দর স্মৃতিগুলোকে কিছুটা ক্যামেরাবন্দী করেছি।

ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন: আহনাফ শাহাদ নিওন (Ahnaf Shahad Nion)

Facebook: Wilep

Share This Article
Leave a comment